Friday 31 January 2014

Sorry. হঠাৎ চাঙা সাইকেলের বাজার.

সুজয় মহাজন ও শুভংকর কর্মকার |, ফেব্রুয়ারী ০১, ২০১৪
পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে দুই চাকার বাইসাইকেল। শহরের অলিগলিতে আজকাল বিষয়টি সহজেই টের পাওয়া যায়। এ জন্য সাইকেলের বাজার দিনে দিনে বড় হচ্ছে। আমদানিনির্ভর এই সাইকেলের বাজারে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের হিস্যা ক্রমেই বাড়ছে।
পরিচিত এই বাহনটির ব্যবসা যে বেশ রমরমা, সেটি পুরান ঢাকার বংশাল এলাকায় গেলে বোঝা যায়। দেশে সাইকেলের বৃহত্তম পাইকারি বাজারে সারাক্ষণই ক্রেতাদের ভিড় লেগে থাকে। গত কয়েক বছরে সাইকেল বিক্রি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। বর্তমানে দুই চাকার এই যানের বার্ষিক চাহিদার পরিমাণ প্রায় পাঁচ লাখ পিস। এমনটাই জানালেন এখানকার ব্যবসায়ীরা।
কিছুদিন আগেও এই সাইকেলের পুরোটাই ছিল আমদানি করা। ব্যবসায়ীরা দেশের বাইরে থেকে বাইসাইকেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আমদানি করেন। তারপর তা সংযোজন করে বিক্রি করা হয়। তবে স্থানীয় বাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২০১১ সাল থেকে দেশি প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাইকেল বাজারজাত শুরু করে। এর আগে প্রতিষ্ঠানটি কেবল ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করত। সামনে আসছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি ইউরোপের বাজারে রপ্তানির জন্য প্রতিষ্ঠানটি শিগগিরই সাইকেল উৎপাদন শুরু করবে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ বাইসাইকেল মার্চেন্টস অ্যাসেম্বলিং অ্যান্ড ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বংশালে দুই শতাধিক বাইসাইকেল বিক্রির প্রতিষ্ঠান আছে। সারা দেশে খুচরা বিক্রেতা আছেন হাজার চারেক। আর ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর মিলে ৭০-৮০ জন আমদানিকারক আছেন, যাঁরা যন্ত্রাংশ কিনে আনেন। 
সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নূরুল হক বলেন, স্পেয়ার পার্টস, রিম, স্পোক ইত্যাদি যন্ত্রাংশ আমদানিতে ৫৫ থেকে ৯৩ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। অন্যদিকে সম্পূর্ণ তৈরি করা বাইসাইকেলের শুল্ক ৯৩ শতাংশ। ফলে এ ক্ষেত্রে একধরনের বৈষম্য রয়ে গেছে। তিনি জানান, শুল্ক হার কমালে সাইকেলের দাম অনেক কমে যাবে। এতে সাধারণ মানুষ বাহনটি ব্যবহারে আরও বেশি আগ্রহী হবে।
তবে গত এক দশক চেষ্টা করেও এই সোজা কথাটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বোঝানো যায়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে সমিতির এই সাধারণ সম্পাদক বলেন, এতে করে চোরাই পথে যন্ত্রাংশ আসছে। সরকার মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ক্রেতারাও ঠকছে।
চাহিদার পেছনের গল্প: ২০১১ সালে কয়েকজন তরুণ রাজধানীতে সাইকেল র‌্যালি শুরু করেন। প্রথম দিকে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল প্রতি শুক্রবার জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা থেকে সাইকেলে করে ঢাকার আশপাশে ঘুরতে যেতেন। এরপর ক্রমেই বাড়তে থাকে শৌখিন সাইকেলচালকদের ওই গ্রুপের সদস্যসংখ্যা। গঠিত হয় বিডি সাইক্লিস্ট নামে একটি সংগঠন।
সাপ্তাহিক ভিত্তিতে শখে সাইকেল চালানো শুরু করলেও গ্রুপের কারও কারও তা ভালোলাগায় পরিণত হয়। এ কারণে কেউ কেউ অফিস-আদালত থেকে শুরু করে নিয়মিত যাতায়াতে রাজধানীতে সাইকেল ব্যবহার করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে সাইকেল চালানোয় সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে নানাভাবে প্রচারণা চালাতে থাকে এই সংগঠন।
বিডি সাইক্লিস্ট দলের অন্যতম মডারেটর মোজ্জাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দলের সদস্য বৃদ্ধির পাশাপাশি সাইকেলের চাহিদা বাড়তে থাকে।’ বর্তমানে এই সংগঠনের সদস্যসংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার বলেও জানান তিনি। সংগঠনের আরেক সদস্য মঈনুল বলেন, কম দামি সাইকেলের বাজারের বড় অংশ এখনো আমদানিনির্ভর রয়ে গেছে।
দেশে বড় বাজার সৃষ্টি হওয়ায় মেঘনা গ্রুপ স্থানীয় বাজারের জন্য ভেলোস ব্র্যান্ডের সাইকেল প্রস্তুত করছে। এ ছাড়া, রপ্তানি বাজারের জন্য তৈরি বিশ্বখ্যাত বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডের সাইকেলও বাজারজাত করছে। এ জন্য ‘সাইকেল লাইফ’ ও ‘সাইকেল লাইফ এক্সক্লুসিভ’ নামে আলাদা দুটি বিক্রয়কেন্দ্র খুলেছে প্রতিষ্ঠানটি।
সাইকেল লাইফ এক্সক্লুসিভের বিপণন ব্যবস্থাপক মঈনুল ইসলাম জানান, রাজধানীতে দুটি বিক্রয়কেন্দ্রে বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে ইউরোপের চারটি ব্র্যান্ডের ৫০০ সাইকেল বিক্রি হয়। এসব সাইকেলের দাম সর্বনিম্ন সাড়ে ১২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া, সাইকেল লাইফে সারা দেশে প্রতি মাসে গড়ে প্রিন্স, গ্রানাডা, রিফ্লেক্সসহ কয়েকটি ব্র্যান্ডের ১৪ থেকে ১৫ হাজার সাইকেল বিক্রি হয়। এসব সাইকেলের দাম সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাত হাজার টাকা।
মঈনুল ইসলাম জানান, ১৭ জানুয়ারি ‘ভেলোস’ ব্র্যান্ডের প্রথম চালানের এক হাজার সাইকেল বাজারে ছাড়া হয়। তিন দিনে তা শেষ হয়ে যায়।
রপ্তানি বাজার: মেঘনা গ্রুপ ছাড়াও জার্মান বাংলা, আলিতা ও নর্থবেঙ্গল নামের প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে তাদের কারখানা থেকে উৎপাদিত সাইকেল বিদেশে রপ্তানি করছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুসারে, গত অর্থবছরে বাইসাইকেল রপ্তানি করে ১০ কোটি ৫০ লাখ ডলার আয় হয়। আর চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে চার কোটি ৪৭ লাখ ডলার আয় হয়, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান কার্যালয়ের (ইউরোস্ট্যাট) তথ্য অনুসারে, ২০১০ সালে বাইসাইকেল রপ্তানিতে অভাবনীয় অগ্রগতি করেছে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে যেখানে ইউরোপে বাইসাইকেল রপ্তানিতে অবস্থান ছিল নবম, সেখানে ২০১০ সালে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে। ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসাব বলছে, এই অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। ওই বছর দেশ থেকে ইউরোপে চার লাখ ৭২ হাজার পিস সাইকেল রপ্তানি হয়।
দেশের পাশাপাশি বাইসাইকেলের আন্তর্জাতিক চাহিদা বাড়ছে। আমেরিকাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লুসিনটেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাইসাইকেলের বৈশ্বিক বাজারের আকার ছয় হাজার ৪০০ কোটি ডলার হতে পারে।

0 comments:

Post a Comment